চলমান মাদকবিরোধী অভিযানের অংশ হিসেবে একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা প্রস্তুত করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। এতে তিন ক্যাটাগরিতে দেড় শতাধিক মাদক গডফাদারের নাম রয়েছে বলে জানিয়েছেন পুলিশ কর্মকর্তারা। এ তালিকায় তিন ওয়ার্ড কাউন্সিলর, তিন পুলিশ সদস্য, দুই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতা, এক আওয়ামী লীগ কর্মী ও ওয়ার্ড পর্যায়ের এক ছাত্রলীগ নেতার নাম রয়েছে বলে জানা গেছে। এদের অন্তত ১১ জনকে গ্রেফতার করে জেল হাজতে প্রেরণ করা হয়েছে।
এর মধ্যে রয়েছে মনির, শাহজাদা, আজিজ, সাজেদা, মোল্লা জালাল, মুকুল ও রুবেল। তাদের দেওয়া তথ্যানুযায়ী রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালাচ্ছে পুলিশ। যেখানে মাদকবিরোধী অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে, সেসব স্থানগুলোই ওই গডফাদারদের ব্যবসায়িক জোন হিসেবে খ্যাত বলে জানা গেছে।
আটক শীর্ষস্থানীয় মাদক ব্যবসায়ীরা পুলিশের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন, তারা মাদকের টাকার অংশ থানার কর্মকর্তা, স্থানীয় রাজনীতিক ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কিছু কর্মকর্তাকে নিয়মিত দিতেন। আর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ভাগ না দিয়ে মাদক ব্যবসা করা তাদের পক্ষে সম্ভব হতো না। রাজধানীর অনেক পুলিশ সদস্যের বাসা ভাড়ার টাকা মাদক ব্যবসায়ীরা বহন করতেন। শুধু তা-ই নয়, পুলিশের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের ব্যয়ভার মাদক ব্যবসায়ীরা বহন করে এসেছেন।
২৩ মে ডিএমপির হেডকোয়ার্টারসে অনুষ্ঠিত এক সভায় ৪৫ জন শীর্ষস্থানীয় মাদক ব্যবসায়ীকে নিয়ে আলোচনা হয়। এর মধ্যে তিন ওয়ার্ড কাউন্সিলর, তিন পুলিশ সদস্য, দুই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতা, এক আওয়ামী লীগ কর্মী ও ওয়ার্ড পর্যায়ের এক ছাত্রলীগ নেতার সম্পৃক্ততার কথা বেরিয়ে আসে। ওই বৈঠক সূত্র জানায়, এ তালিকা ধরে দলবল বিবেচনা না করে শীর্ষস্থানীয় মাদক ব্যবসায়ীদের ব্যাপারে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পুলিশের মহানগরীর আটটি বিভাগের উপকমিশনারদের নির্দেশনা দেন ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া। প্রত্যেকের বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহেরও নির্দেশ দেন তিনি। এ ছাড়া ওই সভায় আরও ১০০ জন মাদক ব্যবসায়ীর তথ্য তুলে ধরা হয়, যাদের প্রত্যেকের নামে থানায় চারটির বেশি মাদক মামলা চলমান বলে জানা গেছে।
জানতে চাইলে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) দেবদাস ভট্টাচার্য এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘আমরা এরই মধ্যে তিন ক্যাটাগরিতে ভাগ করে প্রায় দেড়শ জনের একটি তালিকা প্রস্তুত করেছি। অভিযানের আগেই যেন ওই গডফাদাররা পালিয়ে যেতে না পারে সে জন্য নাম প্রকাশ করা হয়নি। তালিকায় শীর্ষ, দ্বিতীয় ও তৃতীয় সারির মাদক ব্যবসায়ীদের রাখা হয়েছে। মূলত তাদের হাত ধরেই রাজধানীতে মাদকের বিস্তার ঘটত।’
জানা গেছে, প্রথমে রাজধানীতে এক হাজার ৩৮৪ জন শীর্ষস্থানীয় মাদক ব্যবসায়ীর তালিকা প্রস্তুত করা হয়। ৪৯টি থানা এলাকায় নিজস্ব জোন ভাগ করে তারা দীর্ঘদিন ধরে মাদক ব্যবসা চালিয়ে আসছিল। এসব মাদক ব্যবসায়ীর কাছে টেকনাফ, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার থেকে মাদকের বড় বড় চালান চলে আসত। সড়কপথের পাশাপাশি নৌপথ দিয়েও রাজধানীর মাদক ব্যবসায়ীদের কাছে মাদক পৌঁছাত। তবে রাজধানীতে শীর্ষস্থানীয় মাদক ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে নিয়মিত উেকাচ নিতেন কিছু রাজনৈতিক নেতা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের একশ্রেণির কর্মকর্তা। এ কারণে এসব ব্যবসায়ী বরাবরই থাকে ধরাছোঁয়ার বাইরে। এসব ব্যবসায়ীর কারণে রাজধানীর অলিগলি, পাড়া-মহল্লায় অবাধে পাওয়া যেত ইয়াবাসহ বিভিন্ন মাদক। রাজনীতিক, প্রভাবশালী ব্যক্তি ও প্রশাসনের ছত্রচ্ছায়ায় থাকায় রাজধানীর ক্ষমতাশালী মাদক ব্যবসায়ীদের সরাসরি নিয়ন্ত্রণাধীন নগরীর ছয় শতাধিক স্পটে মাদক কেনাবেচা নিয়মিতভাবে চলে আসছিল। এসব স্পটে প্রতিদিন কয়েক কোটি টাকার বাণিজ্য হতো। স্পটগুলো হলো রাজধানীর মোহাম্মদপুর, পল্লবী, কালশী, জেনেভা ক্যাম্প, কমলাপুর রেলস্টেশন, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, চানখাঁরপুল, গ্লোরিয়া, টিটিপাড়া, খিলগাঁও, পুরানা পল্টন, বাড্ডা, ভাটারা, বনানী, গুলশান, মতিঝিল, আরামবাগ, যাত্রাবাড়ী, দক্ষিণ বনশ্রী, ধানমন্ডি, মিরপুর, তেজগাঁও রেলবস্তি, উত্তরা, গাবতলী, কারওয়ান বাজার রেলবস্তি, রূপনগর, শাহ আলী, বংশাল, চকবাজারসহ বিভিন্ন এলাকা।